Kausik Sen, Malala Yusufzahi

মালালার ডাইরি

৯ অক্টোবর, ২০১২

আমরা ফিরছি, রোজ যেমন ফিরি। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। বছরের এই সময়টায় প্রায় প্রতিদিনই অপূর্ব এবং অসহ্য বৃষ্টি হয় আমাদের এখানে। আমার প্রচণ্ড ঘ্যান ঘ্যান পায় বৃষ্টিতে। আমি আব্বু আর আম্মির কাছে ঘ্যান ঘ্যান করি। আমার ভাইজান আমায় রোজ বৃষ্টি দেখিয়ে খ্যাপায়। আমার কান্না পেয়ে যায়। কিচ্ছু ভাল্লাগে না। খেলতে পারি না। দৌড়তে পারি না। পড়তে পড়তে ঘুম পেয়ে যায় খালি।

আমি ফিরছি। ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে ফিরছি। দু'চোখ জুড়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে ফিরছি... হঠাৎ খুব গরম লাগতে আরম্ভ করল আমার। এরকম কখনও হয় না। কিন্তু আজ, এখনই হঠাৎ খুব গরম লাগছে। সাদা কামিজটা হঠাৎ কেন ভিজে গেল তাও বুঝতে পারছি না। বৃষ্টি তো বাইরে পড়ছে। আমি তো বাসের ভিতর বসে, তাও ভিজে গেলাম? খুব অস্বস্তি হচ্ছে মাথার ভিতর। চোখে দেখতেও পাচ্ছি না কিছু। খুব দূর থেকে বাঁশির আওয়াজের মতো কিছু মানুষের গলার আওয়াজ পাচ্ছি। ওরা কেন চিৎকার করছে? আমাকেই ডাকছে বোধহয়। কিন্তু কেন ওরা ওরকম করছে? আমি কি আর কোনওদিন জানতেই পারব না ওরা ঠিক কী বলতে চায়? প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে আমার। মাথার ভিতর অসহ্য যন্ত্রনা, শ্বাস নিতে পারছি না আমি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আম্মুর কোলে মাথা রেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আম্মু কোথায়? তোমরা কেউ ওকে ডেকে দেবে প্লিজ? প্লিজ ডেকে দাও। আর সঙ্গে আব্বুকেও ডেকে দিও। ওদের বলো আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আর আমার জামাটাও ভিজে গ্যাছে। আমার জন্য একটা কামিজ আনতে বোলো প্লিজ। এবারের ইদে আব্বু আমাকে যে কামিজটা দিয়েছে আমি সেটাই পরবো।

তেষ্টা পাচ্ছে খুব। গলা শুকিয়ে কাঠ। আস্তে আস্তে যন্ত্রণাটাও কমে আসছে। আস্তে আস্তে বাতাসও কমে আসছে আমার চারপাশে। আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। মাথার ভিতর থেকে টুপ টুপ করে জল এসে পড়ছে আমার সারা শরীরে। আচ্ছা জলের কি কোনও রঙ হয়? আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না... শুধু একটা নতুন স্বপ্নের ভিতর ঢুকে পড়ছি আমি, আমি, একটা স্কুলবাস, কিছু পরীর মতো বন্ধুরা, আমরা সবাই মিলে দৌড়চ্ছি, আসমানের দিকে ছুটে যাচ্ছি। আর পিছনে তাড়া করছে কিছু দস্যু। আমাদের মাঝে শুধু কিছু অক্ষরের ব্যবধান। ওরা একটা একটা করে অক্ষরকে গুলি করে মারছে। আর ক্রমশ আমাদের ব্যবধান কমে আসছে। হঠাৎ দেখলাম আমি একা, একলা ছুটছি। আর কোনও অক্ষর বেঁচে নেই। ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে আমাদের। আর দস্যুরাও চিৎকার করে ডাকছে আর বলছে, 'আয় তোকে ঘুম পাড়াই'...

প্লিজ তোমরা ওদের বলে দাও...

প্লিজ... আমি আমার আম্মার কোলে ঘুমাবো...

আমি আম্মির কাছে ঘুমাবো...

আম্মির কাছে...

ঘুমাবো...

বিবিসি৩ জানুয়ারি, ২০০৯, শনিবার: আমার ভয় করছে

কাল রাতে আমি খুব ভয়ের একটা স্বপ্ন দেখেছি। মিলিটারি হেলিকপ্টার আর তালিবান দস্যু। সোয়াতে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি এরকম ভয়ের স্বপ্ন দেখি। আম্মির তৈরি নাস্তা খেয়ে আমি স্কুল গিয়েছিলাম। আমার স্কুল যেতে ভয় করে। মেয়েদের স্কুলে না যাওয়ার ফতোয়া জারি করেছে ওরা।

আমাদের ক্লাসে ২৭ জনের মধ্যে মাত্র ১১ জন এসেছে আজ। তালিবান দস্যুদের ভয়েই এত কম বন্ধুরা স্কুলে আসছে। ওদের ভয়ে আমার বন্ধুরা আব্বু-আম্মির সঙ্গে কেউ পেশোয়ারে, কেউ লাহোরে কেউ বা রাওলপিন্ডিতে চলে যাচ্ছে।

আজ বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ কে একটা লোক বলে উঠল, 'আমি তোমাকে খুন করব।' আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়ে দৌড় লাগালাম। একটু পরে পিছন ফিরে দেখি লোকটা মোবাইলে কথা বলছে। ও নিশ্চই ফোনেই কাউকে ভয় দেখাচ্ছিল, বলো?


বিবিসি৪ জানুয়ারি, ২০০৯, রবিবার: আমাকে স্কুলে যেতেই হবে

আজ ছুটি ছিল। খুব দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। প্রায় ১০টা। উঠেই শুনি আব্বু তিন জনকে নিয়ে কথা বলছে। ওই তিন জনই নাকি গ্রিন চকে মরে পড়ে আছে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেনারা আসার আগে রোববার করে আমরা মরঘাজর, ফিজা ঘাট আর কানজুতে পিকনিক করতে যেতাম। কতদিন আমরা পিকনিক যাইনি। প্রায় দেড় বছর।

আগে রাতের খাওয়া হয়ে গেলে আমি আব্বু আর আম্মির সঙ্গে হাঁটতে বেরতাম। এখন সন্ধের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। আজ হোমওয়ার্ক করেছি আর ভাইজানের সঙ্গে খেলেছি। আমার বুক ধুকপুক করছে। কাল আমি স্কুল যাব যে।

বিবিসি৫ জানুয়ারি, ২০০৯, রবিবার: রঙিন জামা পরা বারণ

আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। হঠাৎ মনে পড়ল প্রিন্সিপাল আমাদের ইউনিফর্ম পরতে বারণ করেছেন। বাড়ির জামা পরে স্কুলে যেতে বলেছেন। আমি তো আমার ফেভরিট পিঙ্ক কামিজটা পরে যাব। বাকি বন্ধুরাও রঙিন জামা পরে যাবে।

আমার একটা বন্ধু এসে বলল, 'সত্যি করে বলতো তালিবান দস্যুরা কি আমাদের স্কুলে হামলা করবে?' সেদিনই সকালে প্রেয়ার করার সময় আমাদের বলা হল যেন রঙিন জামা আর না পরে আসি। ওরা বকবে।

বাড়ি ফিরে টিউশন গিয়েছিলাম। সন্ধেয় খবরে শুনলাম ১৫ দিন বাদে শাকার্দ্রাতে কার্ফ্যু উঠে গেছে। মজা হচ্ছে। ইংলিশ আন্টি তো ওখানেই থাকেন। এবারে তাহলে স্কুলে আসতে পারবেন নিশ্চই।

বিবিসি৭ জানুয়ারি, ২০০৯, বুধবার: গুলির আওয়াজ নেই

আমি মহরমের ছুটিতে বুনেইর বেড়াতে এসেছি। আমার বুনেইর খুব ভাল লাগে। কত বড় পাহাড়। কী সবুজ মাঠ। আমার সোয়াতও সুন্দর। কিন্তু খুব অশান্ত। বুনেইর শান্ত। এখানে গুলি চলে না। আমার খুব মজা হচ্ছে।

আমরা আজ পীর বাবার দরবারে গিয়েছিলাম। কত লোক ওখানে। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। সবাই কিন্তু তীর্থ করতে এসেছে। কত চুড়ি, দুল আর হারের দোকান এখানে। আমি ভেবেছিলাম কিছু কিনব। কিচ্ছু পছন্দ হল না। আম্মি অবশ্য হার আর দুল কিনেছে।

বিবিসি৯ জানুয়ারি, ২০০৯, শুক্রবার: মৌলানারা কি ছুটিতে গিয়েছে?

আজ বন্ধুদের বুনেইর বেড়ানোর গল্প বললাম। ওরা নাকি বুনেইরের গল্প শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মৌলানা শাহ দৌরানের মারা যাওয়ার গুজব শুনলাম আজ। এফএম রেডিওতে উনি ভাষণ দিতেন। উনিই তো মেয়েদের স্কুলে আসা বন্ধ করতে চান। গতকাল রাতে ওনার ভাষণ শোনা যায়নি। কেউ কেউ মৌলানার মারা যাবার খবর দিলেও আমরা বিশ্বাস করিনি। একজন বলল উনি নাকি বেড়াতে গিয়েছেন।

আজ শুক্রবার। টিউশনে যাওয়া নেই। আমি সারা দুপুর খেলেছি। সন্ধেবেলা টিভি চালিয়েই লাহোরে বোম ফাটার খবর শুনলাম। পাকিস্তানে এত বোমা ফাটে কেন?

বিবিসি১৪ জানুয়ারি, ২০০৯, বুধবার: আমার মনে হয় আবার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে

কাল থেকে শীতের ছুটি শুরু। তাই আমার মন খারাপ। প্রিন্সিপাল আমাদের বললেন যে কাল থেকে ছুটি। কিন্তু কবে যে স্কুল খুলবে সে কথা কিছুই বললেন না। আগের বারো তো বন্ধের সময়েই খোলার দিনের কথা বলে দিয়েছিল। এবারে কেন বললেন না? আমার মনে হয় ওরা আবার ১৫ জানুয়ারি থেকে মেয়েদের স্কুলে আসা বন্ধ করতে চায়।

আমার কোনও বন্ধুরই ছুটি নিয়ে আর মজা হচ্ছে না। সব্বাই জানে তালিবানরা একবার স্কুল বন্ধ করে দিলে আর স্কুলে আসা হবে না। কেউ কেউ বলছে ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খুলতে পারে। আবার কেউ কেউ সোয়াত ছেড়ে আব্বু আম্মিদের সঙ্গে অন্য জায়গায় চলে যাবে বলছে।

আজ শেষ দিন বলে একটু বেশিক্ষণ খেলা হল। আমার মনে হচ্ছিল যে স্কুল আবার খুলবে। কিন্তু শেষবার স্কুল বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হল যদি আর না আসা হয়!

বিবিসি১৫ জানুয়ারি, ২০০৯, বৃহস্পতিবার: সারারাত গোলার আওয়াজ

সারারাত কামানের আওয়াজে আমার তিনবার ঘুম ভেঙেছে। তবে আজ দেরি করে উঠেছি। স্কুল বন্ধ, তাই সকালে ওঠার তাড়া নেই। আমার বন্ধু এসেছিল। দুজনে মিলে হোমওয়ার্ক করলাম।

আজ ১৫ তারিখ। আজ থেকেই ওদের ফতোয়া শুরু। আমরা তো পড়াশুনা করলাম। কিছু তো হল না!

বিবিসিতে আমার লেখা ডাইরিটাও পরলাম। আমার ছদ্মনামটা আম্মির খুব পছন্দ হয়েছে। আব্বু বলেছে আমার নামটাই বদলে 'গুল মাকাই' রেখে দেবে। আমারো এই নামটা ভাল লাগে। আমার আসল নামের মানে 'দুঃখে কাতর'। আব্বুর কাছে কেউ আমার ডাইরির প্রশংসা করেছে। আব্বু কিন্তু বলতেই পারেনি যে ওটা আমার লেখা...

বিবিসিনভেম্বর ২০১১

আজ সকাল থেকে আমার বাড়িতে খুব ব্যস্ততা। আম্মু, আব্বু দুজনেই খুব ব্যস্ত। কাল আব্বুর কাছে একটা ফোন এসেছিল। ওরা ভয় দেখিয়ে গিয়েছে আব্বুকে। বলেছে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি মিডিয়াকে বিশ্বাস করি। বিবিসি বা নিউ ইয়র্ক টাইমস না থাকলে আপনারা আমার আওয়াজই শুনতে পেতেন না। আজ বিবিসির এক সাংবাদিক বন্ধু আসবে ইন্টারভিউ নিয়ে। আমি তাকে এই কথাগুলোই বলব বলে ঠিক করে রেখেছি। আমি বলব আমাদের খুশাল গার্লস হাই স্কুলের কথা। সবাই জানুক কী জেদ আমাদের। আমরা পড়াশুনো করবই। কোনও তালিবান শক্তি আমাদের আটকাতে পারবে না।


১৪ অক্টোবর, ২০১২

আমি এখনও ঘুমিয়েই রয়েছি। সবাই অনেক চেষ্টা করছেন আমাকে ঘুম থেকে তোলার। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙছে না। সবাই ভাবছে আমি খুব কষ্টে আছি। সবাই ইন্টারনেটে, ফেসবুকে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার আরোগ্য কামনা করে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। কিন্তু ওরা কেউ জানে না এক কদিনে কী আনন্দে আছি আমি। কোনও যন্ত্রণাই আমাকে স্পর্শ করছে না আমাকে। কোনও গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না আমি। কেউ আমাকে ধর্ষণ অথবা খুনের হুমকিও দিচ্ছে না। আমার চারপাশে আর কোনও আততায়ী নেই। আছে রাষ্ট্র প্রধানেরা। আমার নিজের দেশ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সবাই নাকি আমার খবর নিচ্ছেন, আরোগ্য কামনা করছেন। আসলে ওরা কেউ ঘুমতে পারছেন না। যদি পারতেন -তাহলে জানতেন ঘুমে কী অফুরন্ত শান্তি। কয়েকটা বুলেট যে ঘুম উপহার দিয়েছে এই কদিন। এখন আমি বুলেটকেও আর ভয় পাই না। ও আমার বন্ধু। আমার শরীরে জড়িয়ে গিয়ে আপনাদের সবার কাছে আমার কথা বলে দিয়েছে ও। এবার আপনাদের পালা। আমার ঘুম ভাঙুক না ভাঙুক, আমি যতদিন শ্বাস নিচ্ছি ততদিন অনবরত স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি। আমার সোয়াতের স্বপ্ন, আমার প্রিয় কুকুরটার স্বপ্ন, আম্মুর স্বপ্ন, আব্বুর স্বপ্ন। আপনারা জেগে আছেন। আপনারা আমাকে নিয়ে ভাবুন...

আর আমি যদি আবার জেগে উঠি......

কৌশিক সেন
(এক্সিকিউটিভ প্রডিউসর)
Your Comments

jege othho....jege othho... get well soon, malala...

  Post CommentsX  

jege othho....jege othho... get well soon, malala...

  Post CommentsX  

jege othho....jege othho... get well soon, malala...

  Post CommentsX  

jege othho....jege othho... get well soon, malala...

  Post CommentsX  

jege othho....jege othho... get well soon, malala...

  Post CommentsX  

taliban dharmoguruder khuje kothin sasti dite hobe.

  Post CommentsX  

taliban dharmoguruder khuje kothin sasti dite hobe.

  Post CommentsX  

taliban dharmoguruder khuje kothin sasti dite hobe.

  Post CommentsX  
Post Comments