লিচুচোর

লিচুচোর

চাঁদের ফলার মতো কাস্তে সেই আকাশেই রইল। ইয়াবড় কাস্তে নিয়ে লিচুগাছে চড়বে কাকু আর বড়দাদারা। এই ছানাপোনাদের দেখলেই, এই হ্যাট হ্যাট..। এরা তাই তলারই কুড়োয়। পুকুরপাড়ে লিচুবাগান। গাছের তলায় ঘন অন্ধকার। ঠাঠা পড়া গরমে এখানে এলে ঠাণ্ডায় প্রাণটা জুড়োয়। উদোম গায়ে ছেলেপিলে এসে আঁতিপাঁতি করে খোঁজে পাকা টুসটুসে রসভরা ফল। না পেলে চারটি কাঁচা লিচুই কোঁচড় ভরে...

অন্নাভাবে শীর্ণ শিশুদের জন্য প্রকৃতি কত রস ভরে রাখে ফলে মূলে। এদেশে ফলগাছগুলো ছিল বলেই কত না শিশুর পেট ভরে। তাও সর্বজয়ার বুক দুর দুর। সারাদিন টো-টো করে ঘোরা ছেলে-মেয়েদুটো এ-বাগান, সে-বাগান থেকে কী না কী পেড়ে খায়। তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দিয়ে, গলবস্ত্র হয়ে চোখ বুজে একটিই অনুরোধ করে যেতেন, তুমি ওদের দেখো ঠাকুর... ভাইকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গা বেড়ায় এদিক ওদিক। কোন গাছের পেয়ারাটা ডাঁসা থেকে এট্টুখানি পেকেছে।

কোথায় টকলেবু সবজে থেকে হলদে হয়েছে। এইটে মিষ্টি খেয়ে দেখ, বলেই ভাইয়ের মুখে পুরে দিত সে.. উপন্যাসের পাতা থেকে তারপর দুজনে বেরিয়ে যেত হাত-ধরাধরি করে। কত আলোকবর্ষ পথ হেঁটে চিরন্তন হয়ে থেকে গেল আমাদের জলভরা নয়নে। অর্ধভুক্ত, অনাহারের গ্রামচিত্র এমন জীবন্ত হল বিভূতিভূষণের কলমে। এ নশ্বর জীবন বিভূতি হয়ে যাওয়ার আরও পরে, আরও আরও পরে, সেই শিশুরা শিশুই রয়ে গেল। ঈশ্বর তাদের ক্ষুদ্র উদর পূরণের জন্য প্রতি ফলে পুরে রাখলেন জীবনরস.. অনন্তকাল ধরে।

কী খেয়েছিস দেখি? পিঠে দমাদ্দম কিল-ঘুঁষির পর মুখে আঙুল ঢুকিয়ে আলজিভ পর্যন্ত বের করে আনে ছিবড়েগুলো। জ্বরের ঘোরে কাঁপছে ছেলে। সঙ্গে কান্না উচ্চস্বরে। মাগো আমার ছেলেটা কেমন নীল হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের চাতাল জুড়ে ছোট-ছোট বিছানায় হ্যাঁচোড়-পাঁচোড় হচ্ছে তারা.. কী খেয়েছিলি বাগানে? এত খিদে নিয়ে জন্ম কেন তোদের? মর মর..
বিজ্ঞাপন বিরতিতে দেখি লিচুর রস গড়িয়ে পড়ছে টিভির গা বেয়ে। সব ফল ফ্যাক্টরিতে গিয়ে পিষে বোতল হয়ে গেছে। টেট্রাপ্যাকে টইটম্বুর লিচু ড্রিঙ্ক। সার সার বেঁধে এক্ষুণি যাবে সুপারনার্কেটে।

প্রোটিন ভিটামিন মিনারেলের শতকরা ভাগ লেখা আছে প্যাকেটের গায়ে। এক ব্র্যান্ডেড স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শোয়ে বেদম চলছে লিচুগিরি। প্রকৃতির সেইসব শিশুরা নজরুল পড়েনি। বিজ্ঞানের এই চতুর গলিখুঁজিতে পাচার হয়ে গেল তাদের বিন্দু বিন্দু মিষ্টতা। ঈশ্বরপ্রদত্ত, ঈশ্বর-স্বীকৃত সেই সব জীবনরস, সেই সব থোকা থোকা লাল লিচু কোথায় কারা চুরি করে নিল।
গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় এখনও আদুল গায়ে লিচুচোরেরা। খুঁজছে ভাইরাসে ভরে যাওয়া কাঁচা লিচু। জীবনরস আজ মারণরস। ঈশ্বর হেরে গেলেন।
ফুলকলি
Your Comments

monta kharap hoye gelo. jeno nijer chelebela k khuje pelam. bhagabaan - tomar kaaj er kono mathamundu dekhi na. this proves that you are a non-existent factor.

  Post CommentsX  
Post Comments