মধ্যদিবসে মধ্যরাতের শিশুরা

মধ্যদিবসে মধ্যরাতের শিশুরা

ঢাকুরিয়া লেকের পাড়ে যখন থাকতাম, স্কুলে যাওয়ার সময়ে রেললাইন পার করলেই ঢুকে পড়তাম একটা অন্য পৃথিবীতে। মলমূত্র, পচাপাতা, ইঁটপাথর ডাঁইয়ের পাশে কালোকোলো শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে। হাইজিন যেন কোনও দূরের ছবি। সকাল সকাল তাড়াহুড়োয় শনিমন্দিরের সামনে প্রণামটা ঠোকার সময়ে কানে আসত তারস্বরে চ্যাঁচানি। দুই দুগুনে চার, দু-ই দু-গু-নে চা---র। তিন চারে বারো, তি-ন চা--রে বা---রো--। প্রথমটি কোনও পরিণত গলা, দ্বিতীয়টি সমস্বর। চ্যাঁচড়ার বেড়ার জীর্ণ আচ্ছাদনের আলো-আঁধারিতে সর্বশিক্ষা অভিযানের বস্তির ইস্কুল। বেড়ার ফাঁকের ফুটোগুলো ন্যাকড়া বুজিয়ে বন্ধ করা। তারই ফাঁকে আলোর লুকোচুরিতে জীবনের ধারাপাত।
যেদিন স্কুলে তাড়াতাড়ি যেতাম, সেদিন দেখতাম তাদের প্রার্থনা সঙ্গীত। হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর। ধন-ধান্য-পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। বেসুর বেআক্কেলে চিত্‍কার, হুড়োহুড়ি, আঁকাবাঁকা লাইন, ডিসিপ্লিনের বালাই নেই। নাক উঁচু করে চলে যেতাম তখন। আর যেদিন হাফ ছুটি হয়ে বাড়ি ফিরতাম, দেখতাম সেই অপূর্ব দৃশ্যটা...

মলিন, ধূসর স্কুলড্রেস পরা একঝাঁক বাচ্চা। আবার সেই ট্যারা-বাঁকা লাইনে দাঁড়িয়ে, চিলচিত্কার করছে। এক দিদিমণি হাফ-বিরক্ত মুখ করে মস্ত এক হাঁড়ি থেকে বড়সড় লাড্ডুর মত বস্তু তুলে দিচ্ছেন শিশুদের। মহানন্দে তাই-ই তারা খাচ্ছে।
কী দেয় ওটা? মাকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। "ও তো মুন্ডি। ইশকুলের দিদিমণিরা দেয় রোজ। বাচ্চাদের খাওয়াতে বলে। ভিটামিন আছে।" বলেছিল আমাদের কাজের দিদি। তার ছেলে পড়ত কিনা। চুপিচুপি বললাম, আমার জন্য এনো তো। একদিন এনেও দিল, দিব্যি মুগের লাড্ডুর মতো খেতে ছিল। মিষ্টি একটু কম। মনে আছে, মা-ও একটু ভেঙে খেয়ে বলেছিলেন প্রোটিনও আছে। ওটায় নাকি সবরকম ডাল আছে। একটু আটাও। আর চিনি।

সেই খেয়ে সক্কলে বড় হয়ে গেল। কেউ বাড়ি-বাড়ি কাজ, কেউ ছুতোরমিস্ত্রি, কেউ জোগাড়ের কাজ। প্রোটিন ভিটামিন খেয়ে তারা কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার খেলোয়াড় হয়নি। তাদের বসুন্ধরা এখনও ধনধান্যহীনা, আলো আঁধারিতে ঢাকা...

তা সত্ত্বেও কোনওদিন ভুলিনি, বড়সড় লাড্ডুটা হাতে পাওয়ার পর তাদের চোখমুখের সেই অপূর্ব আলোর হাসি। তখনও মিড-ডে মিল নিয়ে সরকারি প্রকল্প হয়নি, তা সত্ত্বেও এরা নিয়মিত খানিকটা খাবার পেত। আজকাল খবরকাগজ খুললেই যে দগদগে ঘা-এর মতো মৃত শিশুর মুখ দেখা যায়, পেস্টিসাইড মাখানো দ্বিপ্রাহরিক আহার খেয়ে...তখনই ছেলেবেলার সেই স্মৃতি আরও স্পষ্ট হয়। উদরপূর্তির বিশ্বে এখনও খাদ্যের অধিকার পায়নি এইসব পরাধীন শিশুরা। অনাহারের জীর্ণতায় ফুলে-ওঠা পেটে খাবারের স্বাদ পড়তে না পড়তেই অন্য জগতে চলে গেল সেই সব সন্তান।
পত্রপত্রিকায় পড়লাম, টিভিতে দেখলাম, ছাপরার স্কুলে সেদিন খুদেদের উপস্থিতি বেশি ছিল কারণ সেদিন তাদের পাঠ্যপুস্তক বিলি করার দিন ছিল। তাই অন্যান্য দিনের থেকে একটু বেশিই ছিল উপস্থিতির হার।

অনেক কিছু লেখা হল। হল অনেক কথা বলা। পলিটিক্যাল কাদাছোড়াছুড়ি, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপান, টক শো, যেমনটা যে-কোনও ইস্যুর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। মিড-ডে মিলের একটা স্টেপল ডায়েট আছে। ভাত, ডাল, সয়াবিন আর আলুর ট্যালটেলে ঝোল। মেনুতে লেখা থাকে অনেক কিছুই কিন্তু থালায় পড়ে এটুকুই। নিউট্রিশনের নিরিখে, এটাও সুষম খাদ্যের তালিকাতেই পড়বে। প্রোটিন ভিটামিন দুটোই আছে। সব আলোচনার মধ্যে ভয়ানক কথাও ছিল একটা। মিড-ডে মিলের জন্য ধার্য অর্থ নিয়ে প্রচুর তছরুপ করছে সরকার, অতএব অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।

সরকার, যাকে ভারতবাসীরা ভিলেন বলতেই পছন্দ করি, তার সবচেয়ে আলোকময় একটি প্রকল্প বন্ধ করতে বলার হেতু কী, কোনও যুক্তিতেই আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। সরকার আসলে সবই করিয়ে দেবে এটাই ভাবা আমাদের স্বভাব। এ দেশই বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ, যেখানে সরকারের জিনিস-কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, সরকারের বসানো জলের কল যথেচ্ছ ব্যবহার এবং প্রতিবাদ করতে হলে সরকারি অফিস ভাঙচুর করাটাই দস্তুর! সমস্যাটা কোনওদিন আমাদের সমস্যা বলে মেনে নিতে পারিনি এটাই চরম দুঃখের। দিনের প্রথম আহার যে-ছাত্রেরা স্কুলে আসার পর পায়, তার উদরপূর্তি যে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব সেটা এখনও মানতে পারিনি আমরা। সরকারের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে শেষ করেছি।

খাদ্যপিরামিডের একটু ওপর থেকে ভাবা যাক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমরা আসলে একটা বিপুল খাদ্যের বিশ্বে বাস করি। মাথার ছাদ আর পায়ের তলার মেঝে পর্যন্ত খাবারে ঢেকে যাবে। হ্যানসেল গ্রেটেলের কাহিনির সেই চকোলেটের বাড়ির মতো। আরও একটু খুলে বললে, সারা বিশ্বে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্তোঁরা, ইটারি, হোটেল। বিভিন্ন দেশের রান্না করা খাবার সেখানে মিলছে। আমাদের রসনাতৃপ্তির অপশন বাড়ছে। এক সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে, বিশ্বের কোনও না কোনও প্রান্তে রেস্তোঁরা তৈরি হওয়ার হার প্রতি মিনিটে প্রায় আড়াইশো-র কাছাকাছি। সেইসঙ্গে অমানুষিক গতিতে বাড়ছে রান্না করা খাবার নষ্ট হওয়ার হার। প্রতি মুহূর্তে। যা আটকানো উত্তরোত্তর অসম্ভব হয়ে পড়ছে। প্রথম বিশ্বে এর হার লজ্জাজনক বেশি। সেই অতিরিক্ত-এর সংস্কৃতি এখন গ্রাস করছে তৃতীয় বিশ্বকেও। আর্জেন্টিনায় কিছু বাচ্চাকে দেখা যায় রেললাইনের ধারে। খাবারভর্তি মালগাড়ি যাওয়ার সময়ে রাতের অন্ধকারে রেলকর্মীরা ছুঁড়ে দেয় বাসি-আধপচা রুটি, কেক। অন্ধকারে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে লুফে নেয় দিনের প্রথম খাবার, সেইসব শিশুরা।

কলকাতার একটি মিষ্টির দোকানে রাত দশটার পর একটি অপূর্ব দৃশ্য দেখতাম। ঝাঁপ ফেলার আগে, প্রতিদিনের বেঁচে যাওয়া লুচি-মিষ্টি বস্তির বাচ্চাদের বিতরণ করা হত। আর সারা রাত দোকানের বাইরের আলো জ্বেলে রাখা হত, গরিবদুখীর ঘরের ছেলেরা যাতে ফুটপাতে বসে পড়াশোনা করতে পারে। কলকাতার কোণে কোণে গজিয়ে ওঠা সুখাদ্যের সার সার রেস্তোঁরায় এখনও তেমন কোনও সহৃদয় মালিকের খোঁজ পাইনি। বরং সকালের দিকে প্রায়ই দেখা যায় প্রচুর পরিমাণে রান্না করা চিকেন-মাটন ভ্যাটে রাশিকৃত হতে। এখনও সেখানে প্রাতরাশের আশায় কুকুরে-মানুষে ভিড় হয়। অন্যদিকে কখন খাবারের দাম চড়া হতে থাকে, বিরিয়ানি-চাউমিন-পিজা-মোমো সবই দ্বিগুণ হতে থাকে চতুর পথে!

জ্ঞানপাপী হয়ে এত সব বলার কারণ একটাই। মিড-ডে মিল যাদের জন্য ধার্য করা হয়েছিল, তাদের শরীরে আব্রু ওঠে দেহের গড়ন স্পষ্ট হতে শুরু করলে। উদরপূর্তি তাদের জীবনে একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পড়াশোনা তো সুদূর গ্রহ! খিচুড়ি ইশকুলে গেলে দিনের উদরপূর্তির প্রথমভাগটা হয়ে যায়...

কদিন আগে কাগজে পড়লাম, এই শহরেরই দুটি মেয়ে বিভিন্ন রেস্তোঁরা থেকে খাবার সংগ্রহ করে "বস্তির স্কুল"-এ টিফিন ব্রেকে বিতরণ করে। কোনও দায় থেকে নয়, হৃদয়ের টানে। খাবার সংগ্রহ করতে যাওয়ার প্রথম দিন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল দুই বোনের। প্রথম রেঁস্তোরায় তারা গিয়েছিল বাড়ি থেকে জোগাড় করা ট্রে নিয়ে। হাঁ করে তাদের দিকে তাকিয়েছিল রেস্তোঁরার ছেলেরা। তারপর নিজেদের হোটেলের ক্রেট ভরে দিয়েছিল কাল রাতের বেঁচে যাওয়া কেক, প্যাস্ট্রি, প্যাটিস, হটডগ...। দোকানের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বাসি খাবার রিপিট করা হয় না। নির্মমভাবে ফেলা হয় ডাস্টবিনেই। কত বেঁচে যায়, হেলায় হারিয়ে যায় ডাস্টবিনের গভীরে, জানা ছিল কি?

যে-ছেলেপুলেরা খিচুড়ি কিংবা ভাত-সয়াবিনে উদর পূরণ করে, তাদের জিভে কয়েকদিনের জন্য আনন্দের স্বাদ পাওয়ানোর থেকে গর্বের আর কিছু আছে কি! তাদেরও কি জানা হয় না ক্ষণিকের জন্য যে, ভাল খাবার দেখতেও কত সুন্দর হয়। একবারও কি তারা মিলিয়ে দেখার সুযোগ পায় না, বর্ণমালা শেখার সময় পাশে যেসব রঙিন খাবারের ছবি থাকে, এই পৃথিবীতে সেটা পাওয়া যায় কি না!

স্বাধীনতার বহু বহু বছর পরেও, এত দুর্ভিক্ষ পেরিয়ে এসেও, খাদ্যের ঔপনিবেশিকতার কোনও সুরাহা হয়নি। স্বাধীন দেশেই বিজয়ী আর বিজিতের বৈষম্য ক্রমেই বেড়েছে। অকারণ। অহেতুক। রেস্তোঁরাতেই আবার কাজ করেন যাঁরা তাঁদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। সংক্ষেপে বলি। একটি পৃথিবীবিখ্যাত রেস্তোঁরায় প্রতি দিন কাস্টমাররা মেনুকার্ড থেকে অর্ডার দেওয়ার পরেও পাতে ফেলে যান আধ-খাওয়া চিকেন ঠ্যাঙ, প্রায় ফুলপ্লেট বিরিয়ানি কিংবা এক কামড়বসানো বার্গার বা আরও কত কিছু। রেস্তোঁরা বয়রা প্লেট সাফ করার সময়ে সেগুলো সরিয়ে রেখে বাকিটুকু ডাস্টবিনে ফেলে। কাজটা যতটা সহজ ভাবছেন ততটা নয়। রেস্তোঁরামালিকের স্ট্যান্ডিং ইন্সট্রাকশন- কেউ খাবার বাড়িতে নিয়ে গেলে চুরির দায়ে ধরা হবে। অতএব? মাথা খাটিয়ে একটা উপায় বের করল সেই বয়। প্লেট তোলার সময়ে খাবার বেছে একটি প্লাস্টিক ব্যাগে পুরে মুখটা শক্ত করে গিঁট বেঁধে দিতেন। ফেলে দিতেন ডাস্টবিনেই। যাওয়ার সময়ে নিজের ব্যাগে অতি সন্তর্পণে ভরে নিতেন। বউ দরজা খুললেই দেখতে পেতেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য। ফুটফুটে চারটি ছেলে আগে থেকেই প্লেট পেতে বসে আছে বাবা আসবে বলে। বাবাকে দেখে হইচই। পলিব্যাগ খুলে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মাংসের ঠ্যাঙ, কোথাও নোংরা লেগে আছে কিনা, কিংবা পচন ধরেছে কিনা। কচি শিশুদের যাতে পেটখারাপ না হয়। আরও বড় কথা, প্রাণসংশয় না হয়। ছানাদের লোভী চোখের সামনে পাতে পড়ে সুখাদ্য। ঘ্রাণে চনমন করে ওঠে তারা। প্লেটে হাত দেওয়ার আগে বাবার মুখের দিকে চায় তারা। ক্রিশ্চান বাবা ইশারায় বলেন, আগে প্রার্থনা করো ঈশ্বরের কাছে। আজকের দিনে মনের মতো খাবার উপহার পেয়েছ, জানাও ধন্যবাদ। তোমাদের মতো কত শিশু আজ না খেয়ে আছে, তারাও যেন এমনি ভাল ভাল খাবার পায়। প্রণাম।

ফুলকলি

পুনশ্চ: শেষ অবধি যাঁরা লেখাটি পড়েছেন, তাঁদের কাছে একটি অনুরোধ রাখতাম। তার আর প্রয়োজন নেই আশা করি


Your Comments

heart touching

  Post CommentsX  

a true reality...

  Post CommentsX  

a true reality...

  Post CommentsX  

besh likhecho...

  Post CommentsX  

well written.. thanks for such a nice writing..

  Post CommentsX  

i understand it is moupia. fulkali r ekta ager lekha dekhe tai mone hoechilo. please accept my heartiest salute.

  Post CommentsX  

i will also with them, i help the children by hart.

  Post CommentsX  

when every person of india can realise the sorrow of the poor children then will survive from poverty and hunger. my appeal to every young men and women to join the drive to end the hunger from india. if they call me i will also with them .

  Post CommentsX  

khob bhalooooooooooooooo

  Post CommentsX  

very well written blog

  Post CommentsX  

ek kathay darun likhechen....asadharan, sattie ei topic ta darkar chilo......

  Post CommentsX  
Post Comments