প্রিয়া ক্যাফে

আমার প্রিয়া ক্যাফে

ক্যাফে কফি ডে-র ওয়েবসাইটটা কেন খুলেছিলাম, সেটা খোলার পর ভাবতে বসলাম। তা না হলে আমার জীবনের এই ছোট্ট গল্পটা একদিন একটি অলস স্মৃতির ভস্মশেষ হয়ে বেঁচে থেকে যেত।

অথবা একটি অমোঘ আকর্ষণ। যা ছেড়ে বেরনোর কোনও রাস্তা আজ অবধি বের করতে পারিনি। অফিসে আসার সময় আর অফিস থেকে ফেরার সময় ওই ক্যাফে কফি ডে। চোখে দেখি আর রোজ মনে ভাসে একটি মুখের ছবি, আর দুটি তারার মতো চোখ।
ওখানেই কথা ছিল মুখোমুখি বসিবার। আমি আর সে। সঙ্গে স্বামীরাও।

-আমার যেদিন অফ-ডে, সেদিন যদি তোমার না থাকে, অফিস ছুটির পর চলে এস বন্ধু। তোমার হাজব্যান্ডের সঙ্গেও তো আলাপ হয়নি, ওকেও এনো।
-তুমিও এনো বরকে। চারজনে একসঙ্গে বসে কফি খাব।
-ব্যাপক। তবে আমাদের টাইমিং...
-সে কথা আর বলতে! আমাদেরও মেলে না, তবে মেলাতে তো হবে। তোমার সঙ্গে সেই যে দেখা হল, আর তো মিট করতেই পারলাম না!

ওর হয় তো আমার হয় না, আমার হয় তো ওর। এই করে করে একটি বছর পার হয়ে গেল। সেই সকালে প্রথম টিভি চ্যানেলের বদলে খবর কাগজে তার মুখ দেখলাম...
কেন দেখলাম, সে গল্পে পরে আসছি। নন্দন চত্বরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অবকাশে তার সঙ্গে প্রথম আলাপ। প্রায়ই একটি দুটি ছবি দেখতে আসে। টিভিতে খবর পড়তে দেখি। হঠাত্‍ যেন কোন অদৃশ্য আকাশ থেকে দুটো তারা খসে পড়ে ঢেকে দিয়েছে চোখ। এমনই বড় তার চোখের মণি।
ফেস্টিভ্যালের সেদিনই যেচে আলাপ করলাম। আট বছরের সাংবাদিকতার পর বেপাড়ায় এই প্রথম। মানে প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। বন্ধুগোষ্ঠি বাড়ানোর চেষ্টায় আছি। খেজুরে আলাপই করলাম।
-আমি তোমাকে টিভিতে দেখি। আলাপ করতে এলাম।
নাম পরিচয় বিনিময়ের পর একগাল হাসি আর উত্তর।
-আমিও তোমার লেখা পড়েছি। জানতাম না তুমিই সেইজন।
সাংবাদিকতায় এমন তাত্ক্ষণিক বন্ধুত্ব সাধারণত হয় না। হলেও তা বেশিদিন থাকে না। পক্ষীকুলে কাক নাকি কাকের মাংস খায়, এমন প্রবাদ আছে। মনুষ্যকুলে এমন অপবাদ শুধু সাংবাদিকদেরই আছে। এমনটাই নাকি সাংবাদিকতার সহজপাঠে লেখা আছে।
-হঠাত্ ট্র্যাক চেঞ্জ করলে? অসুবিধে হচ্ছে না?
-একেবারে হচ্ছে না বলি কী করে! তবে অন্য ট্র্যাকে দৌড়নোর অভিজ্ঞতা আছে। অসুবিধে সামলে নিই।
-কফি খাবে?
-আমি খাই না অত। তবে কোল্ড কফি চলতে পারে।
চতুর্দিকে একবার তাকিয়ে দেখে বলে, এখানে কোথায় পাবে কোল্ড কফি? চলো একদিন ক্যাফে কফি ডে-তে বসি।
সেদিনের আলাপের পর এমন একটা তীব্র যোগসূত্র হয়ে গেল। প্রায়ই ফোনে কথাবার্তা। ইতিমধ্যে আমার ঘর পরিবর্তন হল। এসে পড়লাম তারই শত্রুপক্ষের ঘরে। মিডিয়া বাজারে এই দুই ঘরের রেষারেষি সর্বজনবিদিত। তবে নানা কারণে আর সেটা আর জানানো হয়নি তাকে।
হঠাত্ একদিন ফোন পাই,
-হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তোমাকে দেখলাম চ্যানেলে রিপোর্টিং করছ। তুমি তো জানতাম অমুক চ্যানেলে আছ?
-নাঃ এই কদিন হল এখানে।
-খুব ভাল, খুব ভাল। কেমন লাগছে এখানে?
-ও-ই।
-সবে তো এলে প্রিন্ট থেকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া অনেক লম্বা সময় ফুলকলি। এখন মনে হবে অনেক কিছুই আটকাচ্ছে। একদিন দেখবে, কিছুই আর আটকাচ্ছে না। জলের মতো গড়িয়ে চলেছে।
-হুমমম... আমাদের সেই দেখা করাটা হচ্ছেই না। এবার মনে হয় আমার সঙ্গে তোমার ডে-অফ মিলে যাচ্ছে।
-নিশ্চয়ই। চলো এই রোববার কসবার সিসিডি। আমাদের অফিস থেকে কাছে পড়বে। তোমার বাড়ি থেকেও কাছেই হবে। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
সেই রোববার কী একটা কাজ পড়ে গেল, হল না। পরের শনিবার আবার ফোন ঘোরালাম।
-কী হচ্ছে বলো তো। আমাদের মিটিংটা যে আর হচ্ছেই না।
-এবার হবেই। আমি অফিস থেকে বেরিয়ে দেখা করব। ফোনে ফোনে সব কথা হয় না।
- আমরা প্রথমে দেখা করি। তার পর আমাদের বরকে নিয়ে মিট করব।
-একদম!
আমরা শুধু মিটিং-এর গল্পই করতাম। গল্পে গল্পেই মিট করতাম। সুখ-দুঃখের কথা, অভাব, অভিযোগ কিছুই বাদ যেত না। ভাল-কে ভাল বলা, খারাপ দেখলে শুধরে দেওয়া, টেলিভিশনের টুকটাক টিপস, ছোট বড় গসিপ। দেখাটাই যা হত টিভিতে টিভিতে। জোর কদমে বেশ আগুনে বিষয় নিয়ে চ্যাট চলছে। তারই মধ্যে এসএমএস করলাম,
-চুলের স্টাইলটা এরকমই রেখো। স্কার্ফটা মানাচ্ছে না।
ব্রেকে উত্তর আসত,
-থ্যাঙ্কস ডার্লিং। তুমিও একটু টাচ-আপ করে শুটে বেরিও। সবার মাথা ঘুরে যাবে।
-ডোন্ট বি সিলি!
-ব্রেক ওভার।
টিভিতে দেখলাম প্রবল প্রশ্নবাণে তখন রাজনীতিবিদদের টক্কর দিচ্ছে সে। আমারও অফিস ছুটির সময় হয়ে গেল। আমি পাততাড়ি গুটিয়ে চললাম।
শত্রু চ্যানেল। তবু মাঝেমাঝেই তাকিয়ে থাকতাম ওর খবর পড়া শুরু হলে। তাকিয়ে থাকতাম বললে ভুল হবে। চোখ টেনে নিত। সেই আয়তনেত্র। পাতলা ঠোঁট। নায়িকা হলে অনেকেরই চরিত্রে টান পড়ত, নিশ্চিত।
-তোমার অ্যাঙ্কারিং আজ প্রথম দেখলাম ফুলকলি। দারুণ!
-দেখলে বলেই ভাল লাগছে। দারুণ কিছু হয়নি। অনেক রকম উপদেশ শুনলাম অফিসে।
-কী বলছ! এত ক্লিয়ার ডিকশনে কথা বলতে আমি ইদানীং কাউকে শুনিনি। কজন এমন প্রশ্ন করতে কজন পারে?
-আমি তো শুনলাম আমার সব প্রশ্ন ভুলভাল। অ্যাঙ্কারিং করতে হলে আমাকে আরও চার্মিং হতে হবে।
-ও-সব সমালোচনায় ভড়কে যেও না। বি কনফিডেন্ট।
-আর ভাল লাগে না এসব।
-সব জায়গায় ফুলকলি... কোত্থাও তুমি তোমার কাজের মূল্য পাবে না। তুমি বড্ড সহজ আর সোজা। একটু ডিপ্লোম্যাটিক হও, দেখবে সব তোমার দিকেই চলে এসেছে।
-ভালই বললে।
-আমি জানি। তবে একটাই কথা বলি। অফিসের বাইরে একটা ইউনিভার্স আছে। সেখানে তুমি ইচ্ছেমতো অনেক কিছু করতে পার। একটু ভাবলেই পারবে।

এমনই সব ছোট ছোট কথা। অনেকদিন দেখা না হলে আবার সেই ক্যাফে কফি ডে-তে বসার প্রতিশ্রুতি। তবু দেখা হয় না, কোনও না কোনও কাজ তো পড়েই যায়।
মনে মনে ভাবি, বিভূতিভূষণের মৌরীফুল মেয়েরা তখন থেকে এতটুকু বদলায়নি। ঝুম্পা লাহিড়ির লেখা আলুর বীজের মতো। যেদেশের যে-মাটিতেই পুঁতে দাও না কেন, আলু আলুই থাকবে। রঙ, বর্ণ, গন্ধে কোনও পরিবর্তন হবে না। দূরে-দূরে মেয়েলি বন্ধুত্বের যে-একটা চিরকালীন আর অপরিবর্তনীয় স্বাদ কেমন করে ওর কাছ থেকে পেয়ে গেলাম!
সাংবাদিকতায় তাত্ক্ষণিক বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। এ ক্ষেত্রেও হল না। এবার সেই ছেড়ে আসা গল্পে আসি।
যেদিন সকালে কাগজে প্রথম ওর ছবি দেখলাম, সেদিন প্রথম ওর বাড়ি গেলাম। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে, একে তাকে জিজ্ঞেস করে। সেদিন ওর দেখা পেলাম না। খাটে বসে একা ওর স্বামী। বলল, এস ফুলকলি। তোমার কথা ও খুব বলত।
অনেকদিন পর এই অনুভূতিটা হল। দুঃখ পেলাম, তবু চোখে জল এল না।
-জানি তোমাদের ফোনে অনেক কথা হত। ও আমাকে বলত।
ওর স্বামীর বিষণ্ণ দুটো চোখ। শূন্য ঘর। প্রচুর বইপত্র।
ঠোঁটে এসে গিয়েছিল, এ হপ্তায় দেখা করার কথা ছিল। কসবার ক্যাফে কফি ডে-তে। মুখে কথা সরল না।
বললাম, ও আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল।
সেদিনই প্রথম স্মৃতি খুঁড়ে আবিষ্কার করলাম, অবিশ্বাস্য একটা তথ্য। মাত্র একবারই দেখা হয়েছিল আমাদের! একবারই।
প্রতিদিনের মতো হাসিঠাট্টা-ইয়ার্কি আর তুখড় কাজের পর ছুটির দাঁড়ি টেনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সে। ওপারে যাওয়ার আগেও জানত না সে, কোনও এক জটিল ধরনের প্রেগন্যান্সির "শিকার" হয়েছিল সে। আঙুলের মতো ছোট্ট একটা বেবি ছিল তার দেহে। ডাক্তারও নাকি ধরতে পারেনি।

আজকাল আমাকেও টিভিতে দেখা যায়। তাকে আর দেখতে পাই না।
শেষবার যেদিন দেখলাম ওকে টিভিতে। সাদায়-কালোয়। বার বার কেউ বলল, ওর ছুটি হয়ে গেছে। ডাকঘরের অমলের মতো।
সে চলে যাওয়ার এক বছরও পূর্ণ হয়নি। সেই তারার মতো চোখদুটো, বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের সারি, সেই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সংবাদপাঠিকা কত সব কোলাহলে কোথায় কোন স্মৃতির গভীরে হারিয়ে গেল!
দিনে দুবার যাতায়াতের পথে ক্রস করি কসবার ক্যাফে কফি ডে। আর প্রতিদিন মনে পড়ে তার মুখ। আমার মৌরীফুল। আমার প্রিয়া ক্যাফে।

ফুলকলি
Your Comments

i appreciate your feelings and more than that your courage to write it down online about your opponent channel`s popular anchor ( i guess `sandipta`). yea its really sad that at such young age she passed away and i am sure she had much to give in media and above all to lead a healthy life to the fullest.

  Post CommentsX  

i fill it this is a great story

  Post CommentsX  
Post Comments