ফুলকলি, আয় দোল খেলি

ফুলকলি, আয় দোল খেলি

দোলনায় দুলতে রাজি আছি, কিন্তু দোল না! স্কিনে মেলানিন বেড়ে যাবে, কমপ্লেকশনের বারোটা বেজে যাবে, চুলের টেক্সচারের বারোটা বেজে যাবে। বিরিবিরি আবির ভরা মাথা ইঃ, দাঁতমুখে কালি ছিঃ, কনট্যাক্ট লেন্সে বালি.. এ কি ভদ্রমহিলাদের খেলা! বিশেষ করে আমার মতো সুন্দরীরা দোল খেলে না। যবে থেকে আয়নায় সেল্ফ-অ্যাডমিরেশন শুরু করেছি, তবে থেকেই দোলের দিন প্রচুর অমিতাভ বচ্চনের ছবি আর এফ এম শুনি, সেফ সাইডে থেকে। জিজ্ঞেস করলেই সোজা হিসেব দিই, সবাই যদি রং-বালতি-পিচকিরি নিয়ে নেমে যায়, তবে দেখবে কে?

সেই সময় আবিরলালের সঙ্গে হাবুডুবু প্রেম। ইউনিভার্সিটিতে চার মাস হল ঢুকেছি। ক্যান্টিনে গুজুরগুজুর করি। চোখে কাজল টেনে, লম্বা বেণী দুলিয়ে, পারফিউম স্প্রে করে, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ক্লাস করতে আসি। পদ্মকুঁড়ির মতো রঙের লেটেস্ট নেলপলিশ কিনে পাঁপড়ির মতো নখ রাঙাই। একদিন নয়, সাত দিন ধরে দোল উত্সব চলে সায়েন্স, আর্টস আর ইঞ্জিনিয়ারিং পাড়ায়। প্রচুর গুলতানি দিয়ে স্কিন, কমপ্লেকশন আর হেয়ার টেক্সচারের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে চলি। কিন্তু যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে একটা আনরিটন রুল আছে, যেটা জানা ছিল না। ফোর্থ ইয়ারের দাদারা দিব্য বাঁদর সেজে ফার্স্ট ইয়ারের পুতুলরানিদের সঙ্গে পরিচয় করতে আসে। আগে জানতুম না, তাদের মধ্যেই কারুর বউদি হওয়ার আগাম ইনফো চাউর হয়ে গেলে, টার্গেট ও-ই। তোর বউকে কিন্তু এই দোলে আমরা এট্টুখানি হেঁ হেঁ... অবশ্য তোর পারমিশন নিয়েই, ভালয় ভালয় না দিলে ভবিষ্যত্‍টা একটু অ্যাস্ট্রোলজারকে দেখিয়ে নিস... আরে ঘামছিস কেন? বউদির সম্মান দিতে জানি আমরা। উত্তরে আমার আবিরলাল ঈষত্‍ লালই হয়েছিল বোধকরি, বিশেষ কিছুই বলতে পারেনি। গুপ্তচরের মাধ্যমে সে খবর আমার কানে এসে পৌঁছল।

আচ্ছা, মেয়ে বলে কী আমরা ইয়ে নাকি! এ-পাড়ার গোপিনীদের ডেকে চাঁদা তুলে ফেললাম। টিমইন্ডিয়া ম্যাচ শুরুর আগে যেমন ঘাড়ে ঘাড় হয়ে বেঁধে-বেঁধে ফিসফিস করে নেয়, আমরাও তেমনি করলাম। হলদিরামে গিয়ে ডাব্বা-ডাব্বা লাড্ডু কিনে ফেললাম। ক্লাশরুমে দোর দিয়ে হলদিরামের লাড্ডুকে হাত দিয়ে চ্যাপ্টা করে পুর ভরে আবার গোল্লা-গোল্লা করে দিলাম। খুব সাবধানে প্লাস্টিকের চামচ ব্যবহার করে পুর ভরলাম। কোনওটায় কাঁচা বাঁদুরে রং, কোনওটায় বালি, কাঠকয়লার গুঁড়ো, গাভী এবং সারমেয় বিষ্ঠা। শেষের দুটি জোগাড়ের জন্য টাকা বাঁচিয়ে বিশেষ টিপস দেওয়া হয়েছিল বিশ্বস্ত দারোয়ানদাকে। যথাসময়ে দাদারা এলেন। আরে! হোয়াট আ সারপ্রাইজ, প্লিজ এসো এসো। বাইরে না, ক্লাসে এসো না প্লিজ, আরে ডোন্ট বি সিলি.. কেউ কিছু বলবে না, ছাড়ো তো। একঝাঁক সুন্দরীদের এমন মোলায়েম ব্যবহারে প্রথমেই ঘায়েল। অ্যাই দরজা বন্ধ করিস না, আমরা এখখুনি চলে যাব। রং দেব না রে, শুধু আবির, দ্যাখ! আরে ভয় পেলে নাকি, দরজা বন্ধ করলেও এখানে কেউ কিচ্ছু বলবে না, ডোন্ট ওয়রি! ও আচ্ছা আচ্ছা, ওকে ওকে..অ্যাই ফুলকলি, তোকে সবার প্রথম একটু আবির দিই, আপত্তি নেই তো? হুঁ, আবিরের ভেতরে বাঁদুরে রঙের গুঁড়ো আছে তাও কি আমি জানি না! ওপরে মিষ্টি হেসে বলি, অফ কোর্স নট, তবে আগে লাড্ডু, পরে আবির। এটাই আর্টস-পাড়ার নিয়ম। ততক্ষণে আমার অ্যাসিস্ট্যান্টরা সব হলদিরামের ডাব্বা বের করে ফেলেছে। সমস্বরে বলে উঠেছে, আমরা খাইয়ে দিই? আর-র-র-রে, জমে গেছে! তোরা সিরিয়াসলি মিষ্টি খাওয়াবি.. উফফ্!! বলতে না বলতে, কিছু বোঝার আগেই সব সুন্দরীরা তাদের মুখে ঠুসে দিয়েছে। পার হেড দুই থেকে চার। তার পর সে যা লঙ্কাকান্ড! ভাগ্যিস বাঁদরগুলোর ল্যাজ ছিল না। পরদিন সব্বার কলেজ কামাই। অবধারিত লুজ মোশন।

তখন ফেসবুক ছিল না। থাকলে ওই দাদাদের দুর্দশার ছবিগুলো জ্বলজ্বল করত। হার্ডকপিগুলো এখনও আমার কাছে থেকে গিয়েছে, কাল অ্যালবামে দেখলাম। যাই হোক, সেদিনের পর থেকে আবিরলালকে কাট্টি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বলে এতখানি ইয়ার্কি বরদাস্ত করা সম্ভব না। দুচারদিন লুকিয়ে হ্যাঙ্কিতে চোখটোখ মুছলাম। তারপর সব আগের মতো হয়ে গেল। চোখ কাজল টেনে, বেণী দুলিয়ে, পারফিউম স্প্রে করে মন দিয়ে ক্লাসে পড়া শুনতে শুরু করলাম। পদ্মকুঁড়ির মতো রঙের লেটেস্ট নেলপলিশ কিনে পাঁচড়ির মতো নখ রাঙাতে শুরু করলাম।

পরের বার সেকেন্ড ইয়ার। তত দিনে যুগ যুগ পেরিয়ে গেছে। আবিরলালের কনুই ধরে হাঁটছে ফার্স্ট ইয়ারের আভাননী। ক্যান্টিনে গুজুরগুজুর করছে। কোনও লেভেল-হেডেড মেয়ে এরকম লাল্টু ছেলের প্রেমে পড়তে পারে না। পড়লেও সেটা বেশিদিনের নয় শিয়োর। তার ওপর এমন বিশ্রী চেহারার মেয়েকে কেউ যে লাইক করতে পারে... সিরিয়াসলি বলছি, আমার সাত মাইলের মধ্যেও দাঁড়ায় না। মাঠে নামলে ইজিলি দশ গোলে হারিয়ে দেব! আবার দেখি কী, আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেশি বেশি হাসছে দু'জন। ফোঁস করে উঠল ফুলকলির দিল। দাঁড়া, আজ তো সবে ন্যাড়াপোড়া, কাল তো আসল দোল। তোদের হরিবোল করব কালই!

দোলের দিন সকালবেলা আমার আদরের ল্যাপডগ ফুলকিকে কোলে তুলে নিলাম। নাকে পারফিউমড হ্যাঙ্কি জড়িয়ে, মেডিসিন শপ থেকে আনা কনটেনারে ফুলকির সকালবেলার প্রথম সুসু কালেক্ট করলাম। বড় হকিস্টিক দিয়ে বালতিতে বাঁদুরে রং গুলে দিলাম তাতে। তারপর বন্দুক-পিচকারি করে চোঁ করে তুলে নিয়ে পটপট তিনচারটে বেলুনে ভরে ফেললাম। আজ না ছোড়েঙ্গে হামজোলি, খেলেঙ্গে হাম হোলি। এমন রং-বরষে দেব, জীবনে দোল খেলতে পাবি না। কলেজের দোতলা থেকে টিপ করে আছি। বিকেলের আলোয় দেখা পেলাম। ওই-ওই আসছে, এবার... হরি হে! ফ্যাচাত্ ফ্যাচাত্। মোক্ষম টিপে দুজনের মাথায়। মুখ বেয়ে সে কী বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা আভাননীর। ননীর মতো মুখ বেয়ে গড়াচ্ছে ফুলকির আশীর্বাদ। দোলে ডেবিউ করেই ডাবল সেঞ্চুরি। সোত্সাহে লাফাচ্ছি। পাশ থেকে পিঠে হাত রাখে কেউ। এত লাফাচ্ছ কেন? পেছন ফিরে দেখি কিষণকুমার। ওহ হো, ওর কথা বলিনি। লেট মি ইন্ট্রোডিউস, হি ইজ মাই নিউ বয়ফ্রেন্ড। কিষেণকুমার ননবেঙ্গলি বলে আমার স্লাইট প্রবলেম ছিল, বাট হি ইজ সো হ্যান্ডসাম অ্যান্ড ওয়েলবিহেভড যে, আল্টিমেটলি আই হ্যাড টু স্টার্ট এভরিথিং অ্যানিউ। যাকগে, ওকে সব খুলে বললাম হাসতে হাসতে। ওফ, ফুলকলি ইউ আর সো স্মার্ট। আমার গালদুটো ধরে নাড়িয়ে দিল ও। চুলগুলো আঙুল দিয়ে এলোমেলো করে দিল। আমি রাগের ভান করলাম। মুচকি মুচকি হাসলাম।

সেদিন বাড়ি ফিরলাম বেশ বিজয়োল্লাসের গর্ব চেপে। বাসে অবশ্য কেউ কেউ মুচকি হেসে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি পাত্তাই দিইনি, ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। ফ্ল্যাটের লিফটে আয়নায় হঠাত্ নিজের মুখখানা দেখে আঁতকে উঠলাম। গালে গলায় পিঠে কিষণকুমারের হাতের ছাপ...

বলাই বাহুল্য কিষণকুমারের সঙ্গে কাট্টি হয়ে গেল। সেই প্রথম, ফুলেদের ইতিহাসে প্রথমবার, ফুলকলির স্কিনে দোলের রং লাগল। সেই থেকে মনের দুঃখে, রোজ স্নানের সময়ে সন্দেশ মাখি। বোঁদে দিয়ে স্ক্রাব করি। দুধ ঢেলে ঢেলে স্নান করি। তার পর লুচি দিয়ে গা মুছি। সব সেরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ইউনিভার্সিটি যাই।
Your Comments

oh pholkoli u r so romantic.......

  Post CommentsX  

fulkoli asole sab meyerai ak rakam hoy.nijeder kathai bolte bhalobase besi...amar posa hulor hisi,sisite bhore tomay bhejanor kathata smartly ariye gecho.....but akhono tomay bhulini...tomar abirlal

  Post CommentsX  

iam don don

  Post CommentsX  

কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত, ব্যপ্ত চরাচর, যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর। হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস, উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার, বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার! দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস, অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস, অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ! শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!

  Post CommentsX  

basonto utsaber e heno barnona cum galpo thuri avigyata bes onnorakom.... tumi baro valo lekho fulkoli....

  Post CommentsX  

basonto utsaber e heno barnona cum galpo thuri avigyata bes onnorakom.... tumi baro valo lekho fulkoli....

  Post CommentsX  
Post Comments