Last Updated: November 23, 2011 15:31

এর আগে বেশ কয়েকবার তাঁকে 'গুলিবিদ্ধ করেছে' পুলিস-প্রশাসন। কিন্তু প্রতিবারই সমস্ত দাবিকে ভুল প্রমাণিত করে জঙ্গলমহলের দৃশ্যপটে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তাঁর। তৈরি হয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনীর জাল এড়িয়ে তাঁর রোমহর্ষক পলায়নের কাহিনী। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার বিকেলে বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথবাহিনীর অপারেশন দাঁড়ি টেনে দিল সেই মাওবাদী 'মিথ'-এ। আর সেই সঙ্গেই জন্ম হল এক নতুন বিতর্কের।
তবে কি কিষেণজিকে ভুয়ো সংঘর্ষেই খতম করেছে যৌথবাহিনী?
এর আগে মাওবাদী নেতা সুধাকর রেড্ডি, টেক রমন, আজাদের এনকাউন্টারের পরও উঠেছে এই প্রশ্ন। আর গতে বাঁধা উত্তর মিলেছে প্রশাসনের তরফে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হল না। শুক্রবার বুড়িশোলের জঙ্গলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সরাসরি সাজানো সংঘর্ষের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সিআরপিএফ-এর ডিজি কে বিজয়কুমার। তাঁর দাবি, কোবরা, সিআরপিএফ, রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের জওয়ানদের পরিকল্পিত, মসৃণ অপারেশনেই মৃত্যু হয়েছে সিপিআই (মাওবাদী)-র ৫৬ বছরের পলিটব্যুরো সদস্যের। দীর্ঘ দিনের সোর্স নেটওয়ার্ক গঠন, প্রযুক্তিগতনজরদারী এবং নিপুণ হোমওয়ার্কে ভর করেই এসেছে এই সাফল্য।

সাধারণত মাওবাদী সংগঠনে কিষেণজির স্তরের পলিটব্যুরো সদস্যদের জন্য ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয় থাকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে যৌথবাহিনীর ঘেরাটোপে আটক মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাওয়ের জন্য এতটা আঁটোসাটো 'সিকিউরিটি রিং' গড়ে তুলতে পারেনি তাড়া খাওয়া জুনিয়র কমরেডরা। আর সে কারণেই সংখ্যায় অনেক বেশি নিরাপত্তাবাহিনীর পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যেই মাওবাদী সংগঠনের তৃতীয় শীর্ষনেতাকে খতম করা সম্ভব হয় বলে মনে করেন বিজয়কুমার।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে ইতিমধ্যেই পুরো ঘটনার রিপোর্ট তলব করা হয়েছে। শুধু প্রকৃত ঘটনার অনুসন্ধানই নয়, ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য মাওবাদী প্রত্যাঘাতের মোকাবিলায় রেল, বন্দর ও বিমানবন্দরগুলির নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পি চিদাম্বরমের মন্ত্রক। মাওবাদী উপদ্রুত ৯টি রাজ্যের উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। আগামী ২৭-২৮ নভেম্বর মাওবাদীদের পূর্বঘোষিত বন্ধ পর্যন্ত চূড়ান্ত নিরাপত্তা সতর্কতা বজায় রাখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ স্বরাষ্ট্র দফতরও।
শুধু এপিডিআর, ভারাভারা রাও বা কিষেণজির পরিবারের সদস্যরা নন, বুড়িশোলের জঙ্গলের প্রকৃত ঘটনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সিপিআই নেতা গুরুদাশ দাশগুপ্তও। ঘাটালের সাংসদ জানিয়েছেন, একটি সূত্র মারফত তিনি খবর পেয়েছেন, বৃহস্পতিবার বেলা বারটা নাগাদ গোঁসাইবাঁধের কাছ থেকে কিষেনজিকে আটক করে যৌথবাহিনী। পরে ঠাণ্ডা মাথায় জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয় তাঁকে।

এদিন দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিষেণজির 'সসম্মান' শেষকৃত্যের কথা বললেও যৌথবাহিনীর বৃহস্পতিবারের অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে যা বলায় পুলিস-প্রশাসনের আধিকারীকরা বলবেন। তবে জঙ্গলমহলে 'রুটিন অভিযান' জারি থাকবে বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন তিনি।
সুচিত্রা-সহ মাওবাদী নেতাদের খোঁজে শুক্রবার দিনভর বুড়িশোলের জঙ্গল ও আশপাশের এলাকায় তল্লাসি অভিযান চালানো হয়। সংঘর্ষস্থলের অনতিদূর থেকে এদিন উদ্ধার হয়েছে একটি ব্যাগ। প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ নথি, ওষুধপত্র, কিষেণজির লেখা চিঠি, সিডি এবং পেন ড্রাইভ, ডেটা কেবল, হার্ড ডিস্ক মিলেছে এই ব্যাগে। যৌথবাহিনীর দাবি, এই সিডি, পেনড্রাইভ এবং হার্ড ডিস্ক থেকে মিলবে মাওবাদীদের নেতৃত্ব সম্পর্কিত বহু তথ্য। মিলতে পারে মাও অস্ত্রভাণ্ডার, সোর্স নেটওয়ার্ক এবং রণকৌশলগত খুঁটিনাটির সুলুকসন্ধানও। ব্যাগের ভিতর একটি 'লেডিজ পার্স' মেলায় এটি মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর বলে মনে করছে পুলিস।
এদিন দুপুরে ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতাল থেকে মেদিনীপুর জেলা হাসপাতালের মর্গে আনা হয় কিষেণজির দেহ।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই নিহত মাওবাদী নেতার ভাইঝি দীপাকে নিয়ে কলকাতায় আসেন অন্ধ্রপ্রদেশের বিশিষ্ট লেখক-কবি ভারাভারা রাও। দমদম বিমানবন্দরে নেমেই এপিডিআর নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যান তাঁরা। কিষেণজির মৃত্যুর খবর শোনার পর অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগরে তাঁর নিজের গ্রাম পেড্ডাপল্লিতে ছিল শোকের আবহ। নিহত মাওবাদী নেতার ক্যান্সারে আক্রান্ত ৮৫ বছরের মা কিংবা সহপাঠী সরলাদেবী থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই মনে করছেন অন্যায় যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও।
First Published: Saturday, November 26, 2011, 16:34