সুরসম্রাটের নারীরা

সুরসম্রাটের নারীরা

সুরসম্রাটের নারীরা পণ্ডিত রবিশঙ্করের সৃষ্টির মতোই বৈচিত্রময় ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও। তাঁর বোহেমিয়ান মন কোনওদিনই বাঁধা পড়েনি সাংসারে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এই মহীরুহ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিরত থেকেছেন বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে। তবে সবকটি প্রেমই ছিল স্বতন্ত্র। তাঁর জীবনে একই সময়ে একাধিক নারী থাকা সত্ত্বেও বরাবরই পৃথক পরিধিতে বিরাজ করেছেন তাঁরা।

প্রায় কিশোর বয়সে গুরু আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় রবি শঙ্করের। দুটি সন্তানও হয় তাঁদের। সুরের প্রতি অদম্য টান দু`জনকে কাছাকাছি আনলেও বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তাঁদের। চল্লিশের দশক থেকেই তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরলেও ষাটের দশকের প্রথম দিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছাড়াছাড়ি হয় দু`জনের। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেই নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় রবিশঙ্করের। তবে সেখানেও তিনি বাঁধা পড়েননি কোনওদিন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে স্বামী, স্ত্রীর মতো জীবনযাপন করলেও ওই সময়েই আরও দু`জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। জন্ম দিয়েছেন দুই মেয়ের। আত্মজীবনী রাগ মালায় রবিশঙ্কর লিখেছিলেন, "আমি অনুভব করতাম আমি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারীর প্রেমে পড়তে পারি। প্রতিটি বন্দরে একজন নারী থাকার মতো.....সেটা অনেক সময় একের জায়গায় একাধিকও ছিল।"
সুরসম্রাটের নারীরা
কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন ১৯৭২ সালে তাঁর কনসার্টে তানপুরা সঙ্গত করেছিলেন সুকন্যা রাজন। সুকন্যা বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৮১ সালে সুকন্যা তাঁদের একমাত্র মেয়ে অনুষ্কার জন্ম দেন। তার আগে ১৯৭৯ সালে নিউ ইয়র্কে তাঁর কনসার্টের আয়োজন সু জোনসের প্রেমে পড়েন রবিশঙ্কর। ওই বছরই জন্ম হয় তাঁদের সন্তান নোরা জোনসের।

অনুষ্কার জন্মের পরও বহুদিন পর্যন্ত সুকন্যার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যাননি রবিশঙ্কর। যদিও অন্য দু`জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রবিশঙ্করের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সুকন্যা বরাবরই চেয়েছিলেন তাঁকে বিয়ে করতে। মনস্থির করতে পারেননি রবিশঙ্কর। একটি ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাত্কারে সুকন্যা জানিয়েছিলেন, "রবিশঙ্কর তখন ৫৮ বছরের পৌঢ়। আমাকে বলেছিলেন উনি নিজেকে বদলাতে পারবেন না। ওঁকে এতোটাই ভালবাসতাম যে বছরে মাত্র কয়েকটা দিন উনি আমার সঙ্গে কাটালেই আমি খুশি হতাম। সেই কয়েকটা দিনের জোয়ারে আমি সারাবছর কাটিয়ে দিতে পারতাম।"
সুরসম্রাটের নারীরা
রবিশঙ্কর যখন সুকন্যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন সু জোনস তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলেন। এমনকী মেয়ে নোরার সঙ্গেও রবিশঙ্করকে কোনওদিন দেখা করতে দেননি। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দু`দশকের সম্পর্ক ভেঙে যায় তখন। ১৯৮৯ সালে অনুষ্কার ৮ বছর বয়সে সুকন্যাকে বিয়ে করেন রবিশঙ্কর। প্রেম বহু নারীর থেকে পেলেও সুকন্যাই তাঁর জীবনে স্থায়িত্ব এনে দেয়।

রবিজি কোনওদিনই সেভাবে পারিবারিক জীবন পাননি। খুব কম বয়সে বিয়ে হয় ওনার। যখন সমস্যা শুরু হয় উনি বিদেশে অনুষ্ঠানে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করেন। উনি সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান ছিলেন। অবশ্যই ওনার জীবনে কমলা আন্টি ছিল। কিন্তু উনিও রবিজিকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আমি ওনাকে সংসার দিতে চেয়েছিলাম যা উনি সত্যিই কোনওদিন পাননি। সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন সুকন্যা।

সুকন্যা শঙ্করের কাছ থেকেই রবিশঙ্কর ভালবাসা, খুশি, স্থিতি সবকিছুই পেয়েছিলেন। সুকন্যা শুধু তাঁর দোষত্রুটিই মেনে নেননি, তাঁর আসেপাশের মানুষগুলোকেও কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল রবিশঙ্করের। পণ্ডিতজিতে কমলা বলেছিলেন সুকন্যাকে বিয়ে করাই তাঁর জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। তাঁর জীবনের সব নারীরাই বিভিন্ন সময়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবুও আজীবন ভালবেসে গেছেন সকলেই। আসলে তিনি ছিলেনই স্বতন্ত্র। তাঁর সৃষ্টির মতোই।

First Published: Wednesday, December 12, 2012, 19:59


comments powered by Disqus