Last Updated: October 7, 2013 18:03

কৌশিক সেন
কলকাতা থেকে কয়েকদিনের ছুটি চুরি করে পাড়ি দিয়ে ছিলাম উত্তরাখণ্ডের দিকে। ব্যস্ত কলকাতা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া গিয়েছিল মাত্র একটা সপ্তাহ। ডেস্টিনেশন ভীমতাল, নৈনিতাল, সাততাল, মুক্তিনাথ। তখনও উত্তরাখণ্ডকে ছুঁয়ে যায়নি বন্যার ভয়াবহতা।
হাতে সময় কম। তাই কলকাতা থেকে দিল্লির দূরত্বটা চটজলদি প্লেনেই কাটিয়ে দিলাম। দিল্লি থেকে কাঠগোদাম হয়ে পৌঁছে গেলাম ভীমতাল। সময় লাগল পাক্কা ৯ঘণ্টা।
অসাধারণ নৈস্বর্গিক নিঃস্তব্ধতায় জেগে থাকে ভীমতাল। ভীমতালের ধার ঘেঁসে কোথায় যেন মিশে যায় দিগন্তের নীল পাহাড় আর সবুজ বন। সঙ্গে নভেম্বরের হিমেল হাওয়া খেয়াল খুশির আঁকিবুকি কাটে বিশাল ভীমতালের জলে।
ভীমতালে আমারা বাসা বেঁধেছিলাম কান্ট্রি ইন হলিডে রিসর্টের একটা ছোট্ট কটেজে। এই রিসর্টের ঠিক পিছনেই ভীমতালের রাজকীয় অবস্থান।
ভীমতালে রাত কাটিয়ে পরের দিনই ভোরভোর রওনা দিলাম মুক্তিনাথের উদ্দেশ্যে। ভীমতাল থেকে প্রায় ৩৫০০ ফুট উপরে অবস্থিত মুক্তিনাথের উচ্চতা ৭৫০০ ফুট। মুক্তিনাথের রাস্তা পাইনে ঘেরা। পথে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকে পাইনফল। মুক্তিনাথে পৌঁছে দেখলাম নন্দাঘুন্টি, ত্রিশুল বরফের সাদা জামা গায়ে চাপিয়ে আমাদের ওয়েলকাম করতে সাতসকালেই এক্কেবারে রেডি হয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের রোদ তাদের সাদা জামায় মনের সুখে চুমু ছড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হয় হাত বাড়ালেই বুঝি ছুঁয়ে ফেলা যাবে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও ছোঁয়া আর যায় না।

দ্বিতীয়দিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাড়ি দিলাম নৈনিতাল আর সাততালের উদ্দেশ্যে। নৈনিতাল ঘিঞ্জি কিন্তু ভীষণ পরিষ্কার আর প্রাণচঞ্চল একটা শহর। সারা শহর নিজের প্রতিচ্ছবি অবিরাম দেখে চলেছে নৈনিতালের আয়নার মত ঝকঝকে জলে। নৈনিতালের ধারেই নৈনি দেবীর মন্দির। তার ধার ঘেঁসে একের পর এক মোমবাতির দোকান নিয়ে হাজির স্থানীয়রা। রকমারি রঙিন মোমবাতির, কতরকম তার আকার। তার পাশেই শীত পোষাকের পসরা সাজিয়ে আছেন ভুটিয়ারা। নম্ভেম্বরে কাঁপাকাঁপি ঠাণ্ডায় ভ্রমণপিপাসু বাঙালির ভ্রমণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ শপিংয়ের রসদ পুরোটাই মিলল নৈনিতালে এসে।
তবে রাত কাটানোর জন্য আমরা বেছে নিলাম সাততালের অসম্ভব নির্জন অন্ধকারকে।
তৃতীয় দিনে সক্কাল সক্কাল রওনা দিলাম রানিখেত আর আলমোড়ার দিকে। ভারতীয় সেনা বাহিনীর কুমায়ুন ও নাগা রেজিমেন্ট এই রানিখেতেই অবস্থিত। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকার কারণেই রানিখেত শহরটি অসম্ভব পরিচ্ছন্ন এবং কিছুটা কেতাদুরস্তও। জনসংখ্যা খুব বেশি নয়।
পাইন, ওক, দেওদারে ঘেরা রানিখেতের নম্ভেবরের সকাল কুয়াশায় তখন মাখামাখি। কুয়াশার আবছা দৃশ্যপটের মধ্যে দিয়ে অনন্য হয়ে উঠেছিল পশ্চিম হিমালয়ের শৃঙ্গরাজি।
রানিখেতের পরের ডেস্টিনেশন ছিল আলমোড়া। ঘোড়ার জিনের মত ঢিবি আকৃতির এই উপত্যকা। পাইন আর ফারের ঘন জঙ্গলে ঘেরা। আলমোড়ার পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে যমজ নদী। কোশি আর সুয়াল। জঙ্গল, পাহাড় আর নদী, এই তিন বন্ধুর বন্ধুতার ছবিতে আমাদের চোখে তখন ঝিলমিল। ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করলাম স্থবির কিছু ছবি।
পরের দিনটা তুলে রেখেছিলাম কৌশানির জন্য। কৌশানির রূপের তুলনা শুধু সেই। কোন উপমা দিয়ে এই কৌশানিকে ব্যাখা করার চেষ্টা বাতুলতা। একদিকে চোখ মেলে তাকাতেই খুঁজে পেলাম বরফে মোড়া পঞ্চচুল্লি, ত্রিশুল আর নন্দাদেবীকে। নীচের দিকে ঘন পাইনের বনে ঘেরা গরুর আর বৈজনাথ-কাটুয়রি উপত্যকা। যার একদিকের বুক চিড়ে আলমোড়া-বাগেশ্বর-দিদিঘাট হাইওয়ের দৃপ্ত উপস্থিতি।
বিকেলে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশের পথ ঘুমের দেশের যাত্রী, আকাশে তখন কমলা রঙপেন্সিলের অবুঝ দৌরাত্ম। পাইনের বনও তখন অন্ধকারের অহংকার গায়ে মেখে নিয়েছে। কিছুটা পড়েই রাত যখন নামল দূরে উপত্যকার বুকে সন্ধের বুক চিড়ে হাজার জোনাকির মত জ্বলে উঠল বিজলী বাতি। কৌশানি সুন্দরী তার অনিন্দ্য রূপের আর এক দিক উন্মোচন করল আমাদের চোখের সামনে।
এরপর বাড়ি ফেরার পালা। কলকাতা, কলকাতা মন কেমনের টানে রূপসী কৌশানির মায়া কাটিয়ে ফিরে আসা ব্যস্ত শহরের জঙ্গম রাজপথে।
First Published: Tuesday, October 8, 2013, 17:41